রাজনৈতিক অভিজাত বা সেনাবাহিনীর অফিসার বৃত্তের বাইরে সাধারণত কেউ ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট হননি। তা ছাড়া বিশ্বের জনসংখ্যায় বৃহত্তর এই মুসলিম রাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হওয়াটাও চাট্টিখানি কথা নয়। সেখানে সামান্য ফার্নিচারের দোকানির ছেলে হয়ে জোকো উইদোদো হলেন সে দেশের সপ্তম প্রেসিডেন্ট। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানাচ্ছেন— chakarianews.com
জিতে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের হৃদয়
২০০৫ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সুরাকার্তার মেয়র ছিলেন। মেয়রের পদে লড়ার সময় তাঁর সম্পদ ও আসবাবপত্রের ব্যবসায়ী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু তিনি জনসাধারণের সঙ্গে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। মেয়র হওয়ার পর তিনি নিজ শহরকে যুগোপযোগী করার জন্য ইউরোপীয় উন্নয়ন কাঠামো নীতি গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের প্রথম কাজ হিসেবে সবাইকে তাক লাগান দুর্লভ জিনিসের মার্কেট ও গৃহস্থালি দ্রব্যের মার্কেট বা নতুন প্রথাগত মার্কেট তৈরি করে। তা ছাড়া সুরাকার্তার প্রধান সড়কের পাশাপাশি ৭ কিমি দীর্ঘ সড়ক ও তিন মিটার চওড়া ফুটপাথ নির্মাণ করেন। শহরের পার্ক সংস্কার, রাস্তার পাশের গাছ সংরক্ষণ এবং শহরকে সংস্কৃতি ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি জাকার্তার গভর্নর ছিলেন। জাকার্তার গভর্নর থাকাকালীন জোকো ব্লুসুকান নামক নীতি অনুসরণ করেন। এর মাধ্যমে নিয়মিত জাকার্তাব্যাপী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত দরিদ্র এলাকায় ভ্রমণ করতেন। সফরে তাঁকে সাধারণ পোশাকে দেখা যায়। তিনি এ সময় বিভিন্ন বাজার ও সরু গলিতে হেঁটে বাসিন্দাদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন খাদ্যের মূল্য, আবাসন সমস্যা, স্থানীয় বন্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থা এসব বিষয়ে খোঁজ নিতেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে যে, তাঁর এসব কর্মপ্রণালি জাকার্তা ও ইন্দোনেশিয়ার অনত্র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছে। ২০১৪ সালের এপ্রিল ও জুন মাসে জোকো লেলাং জাবাতান নামক আমলাতান্ত্রিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করেন। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী যোগ্যতা পূরণ ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পদ লাভের সুযোগ পেতেন। ২০১৪ সালের ২২ জুলাই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি প্রশংসনীয় অনেক কাজ করেন। ২০১৫ সালের প্রথম চতুর্ভাগে জিডিপি ৪.৯২% বৃদ্ধি পায়। মাদক ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও তার নির্দেশে এ ধরনের অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় কঠোরভাবে। তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লেও দেশের স্বার্থে যে কোনো নীতি গ্রহণ করেন। সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকদের সুরক্ষা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কূটনীতি বৃদ্ধি হলো তাঁর নীতি।
কাঠুরে পরিবারের সন্তান
ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬১ সালের ২১ জুন। জোকো উইদোদো জাভানিজ বংশোদ্ভূত। নাম পরিবর্তনের আগে তাঁকে মুলয়ুন ডাকা হতো। বাবা নোতো মিহার্জো এবং মা সুজিয়াতমির চার সন্তানের সবার বড় ছিলেন জোকো। তাঁর দাদা বোয়য়োলালির এক ছোট গ্রাম থেকে এসে কারানগানায়ারে বসত গড়েন। আর তাঁর বাবা সেখান থেকে জাভায় চলে যান। অসচ্ছল নাগরিকদের স্কুল বলে পরিচিত স্টেট প্রাইমারি স্কুল ১১১, টিরটুয়ুসুতে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১২ বছর বয়সে বাবার আসবাবপত্রের দোকানে কাজ শুরু করেন তিনি। মাধ্যমিক পার হতেই তিনবার অকৃতকার্য হন। প্রাথমিকের ধাপ শেষে স্টেট জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হন। তারপর স্টেট সিনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায় নিম্ন সারির একটি স্কুলে ভর্তি হন। আসবাবপত্রের দোকানে কাজ করতে করতে কাঠ আর তৈরি আসবাবপত্রের ওপর আগ্রহ জন্মে। এরপর অনেক অর্থকষ্টের মধ্য দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যান। যুগজাকার্তার গাদজাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি অনুষদ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন ১৯৮৫ সালে। সেখানেই তিনি প্লাইউড ব্যবহারের ওপর গবেষণা করেন। জোকো ও তাঁর স্ত্রী ইরিয়ানার তিন সন্তান রয়েছে।
অন্যরকম একজন
খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেও জিতে নিয়েছেন সম্মানজনক অবস্থান। আস্থা গড়েছেন মানুষের হৃদয়ে। শুধু মানুষের ভালোবাসা নয়, কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। দেশীয় সম্মাননা হিসেবে পেয়েছেন বিনতাং জাসা উতামা-২০১১, বিনতাং রিপাবলিক ইন্দোনেশিয়া আদিপুরনা-২০১৪। তাঁর অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে বিদেশি সম্মাননাও। ব্রুনাই থেকে পেয়েছেন দারজাহ কেরাবাত লাইলা উতামা ইয়াং আমাত দিহুরমাতি-২০১৫। সৌদি আরব তাকে অর্ডার অব আবদুল আজিক আল সৌদ-২০১৫ পদক দিয়েছে। এ ছাড়াও ২০০৮ সালে টেম্পু ম্যাগাজিন কর্তৃক সে বছরের শীর্ষ দশ মেয়রের অন্যতম হিসেবে পুরস্কার পান। এ ছাড়াও ২০১২ সালে অপরাধপ্রবণ শহর থেকে শিল্প, সংস্কৃতি ও পর্যটক আকর্ষণের শহরে রূপান্তর কৃতিত্বে বিশ্ব মেয়র পুরস্কারের জন্য তৃতীয় স্থান লাভ করেন। ২০১৩ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন কর্তৃক সে বছরের নেতৃস্থানীয় বিশ্ব চিন্তাবিদের অন্যতম হন। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনভিত্তিক দ্য সিটি মেয়রস ফাউন্ডেশন কর্তৃক গ্লোবাল মেয়র অব দ্য মান্থ হিসেবে মনোনয়ন লাভ করেন। ২০১৪ সালে ফরচুন ম্যাগাজিন কর্তৃক বিশ্বের ৫০ জন বড় নেতার তালিকায় তাঁর স্থান হয়। রাজনৈতিক এই নেতা শুধু দেশ ও মানুষ নিয়েই সব ভাবনার রাজ্য পেতে বসেন তা কিন্তু নয়, তিনি বড়সড় মাপের একজন সংগীতপ্রেমী। তাও যেনতেন সংগীত নয়, হেভি মেটাল ব্যান্ড। সে হিসেবে বলা যায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন উইদোদো হেভি মেটাল সংগীতের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। সভা-সমাবেশ বা টিভি অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই তিনি উপস্থিত হন প্রিয় ব্যান্ডের টি-শার্ট পরে। তাঁর প্রিয় ব্যান্ডের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ‘মেটালিকা’। এ ছাড়াও ‘লেড জ্যাপেলিন’, ‘ল্যাম্ব অব গড’ বা ‘মেগাডেথ’সহ অনেক ব্যান্ডই থাকে এই মেটালহেড প্রেসিডেন্টের প্লে লিস্টজুড়ে! ইন্দোনেশিয়াতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের কারণে পশ্চিমা সংস্কৃতিচর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। উপরন্তু হেভি মেটাল সংগীত সে দেশে একদমই সমাদৃত নয়। অথচ সেখানে একটি অতি সাধারণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা জোকো পছন্দের দিক থেকে কারোই যেন ধার ধারেননি।
পাঠকের মতামত: